অসমাপ্ত প্রেম - সুবোধ কুমার শীট

ছেলেটির ডাক নাম বাসুদেব। তার বড়োমা তাকে খুব আদরের সাথে এই নামেই ডাকে। সুবোধ বলে ডাকে ছেলেটির ঠাকুমা হেমাঙ্গিনী মহাশয়া, যিনি ছিলেন পুরোনো দিনের সাহসিনী, দরদীনি, মমতাময়ী ও কর্মঠ এক ভদ্র মহিলা। তিনি কিন্তু ছেলেটির প্রিয় বন্ধুও বটে। ছেলেটিকে শৈশব থেকে পড়াশোনা, গল্প বলা, সঠিক পথে চলা, কোনটা ঠিক কোনটা মন্দ তা বোঝানো সবই তার বাবা-মায়ের থেকে অনেক বেশি অবদান আর প্রিয় বন্ধু ঠাকুমার। ছেলেটি দুষ্টুমিতে দিদি, মা, ঠাকুমা, ঠাকুরদা ও বাবা কাউকে ছাড়তো না। এগারো বছরের ছেলেটি শুধু দুষ্ট নয়, ছোটবেলা থেকে তার সমস্ত ভাবনা প্রিয় ডাইরির পাতায় কবিতা ও গল্প আকারে লিখে রাখা ছিল তার শখ। হ্যাঁ, ছোটবেলা থেকেই একটু ভাবুক প্রকৃতির ছিল।

                বিকেল হলে তার বাবা কখনো কখনো তাকে একই গ্রামে একটু দূরে থাকা তার বন্ধুর বাড়িতে নিয়ে জেতেন। ব্যাপারটা হল তার বাবার বন্ধুর প্রায় সাত বছরের ছোট্ট মিষ্টি একটি মেয়ে রয়েছে। আর এই দুষ্টু ভীতুরাম মেয়েটিকে দেখলে লজ্জায় দুই গাল যেন পাকা টমেটোর মতো লাল হয়ে যেত। চোখে চোখ তাকানো তো দূরের কথা। তার দুষ্টুমি সব ঘুচে যেত, চুপটি করে বাবার কাছে বসে থাকতো। মেয়েটির বাবা-মা ভীতুরামকে খুব ভালোও বাসে কারণ তাদের কোন ছেলে ছিল না। তারপর বাবার সঙ্গে বাড়ি আসার পথে ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে মেয়েটিকে দেখতো। সে দূর থেকে যখনই মেয়েটিকে দেখতো তখনই মনে অনন্য উল্লাসে আত্মহারা সঙ্গে তিল আধ বিষন্নতার ভাবনা ভরে যেত। কারণ মেয়েটি একটু রোগা ছিল। অথচ ভীতুরামের বাড়িতে সবাই মোটা কিন্তু সে নিজে নয়। সে আবার এ বলেও নিজের মনকে শান্তনা দিতো, ‘ও বড়ো হলে সব ঠিক হয়ে যাবে’। ছোট ভীতুরাম লজ্জা ও ভয়ে কোনদিন কাছেও যায়নি আর মেয়েটির সাথে এখন পর্যন্ত কথাও বলেনি কিন্তু দূর থেকে দেখলে সদা এই অনুভূতি হতো যে, ‘যেন মেয়েটি বহুদিনের চেনা-জানা, সে যেন নিজের মানুষ’। সে এখনও বুঝে উঠতে পারছে না যে সে মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেলেছে। তখনও মেয়েটির নাম যে সুনন্দিতা তাও জানতো না। এগারো বছরের ভীতু ছেলেটা শুধুই প্রেম অনুভব করেই গেল। 

              এই ভাবে ছয়টি বছর তার কেটে গেল দূর থেকে মেয়েটিকে দেখতে দেখতে। ভীতুরাম কিন্তু আর ভীতু নেই একাদশ ও দ্বাদশ এই দুই বছর অনেক বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে আলাপ কিন্তু কম কথাই বলতো, প্রয়োজন হলে তবে কথা। তাদেরই মধ্যে প্রিয় হাতে গোনা দুই বন্ধু ও দুই বান্ধবী। সে একটু চাপা ও ভাবুক প্রকৃতির ছেলে, কোন কিছু প্রকাশ না করলে কেউ এতো সহজে তাকে বুঝতে পারবে না। স্কুলে প্রায়ই প্রথম বেঞ্চে খোদাই থাকতো তিন বন্ধুর জায়গা। তিনবন্ধু বলতে বিধান, ফিরোজ ও আমাদের ভীতুরাম। তিনবন্ধু একই গ্রামের ছেলে। কিন্তু বিধান ছিল ওই স্কুলের ছাত্র। আর ফিরোজ ও ভীতুরাম অন্য স্কুল হতে এসেছে। তারা দুইজনে ছোটবেলার প্রিয় বন্ধু, এক সঙ্গে পড়াশোনা ও বড়ো হওয়া। স্কুলে ভীতুরাম টিফিন হোক বা ক্লাস শুরুর আগে একই জায়গায় বসে গালে হাত দিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে ভাবতো সেই মেয়েটির কথা, তখন তার নামও জানতো। এই দেখে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বেঞ্চের মেয়েরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতো, ‘এ কবি সুকান্তের মতো গালে হাত দিয়ে কি যে ভাবে? টিফিন পড়েছে দেখ একা গালে হাত দিয়ে বসে আছে’। ফিরোজ কিন্তু টিফিনের সময় খুব তাড়াতাড়ি বাহির থেকে ঘুরে তার কাছে চলে আসতো। বিধান বা একটু পরেই আসতো। চমৎকারের ব্যাপার এটাই যে, তার ক্লাসে প্রিয় দুইজন বান্ধবীর মধ্যে একজনের আচরণ হুবহু ভীতুরামের হৃদয়ের বাল্য প্রেমিকা সুনন্দিতার মতো। রূপ, গঠন, অন্তরের ভাব কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন, শুধু আচরণ হুবহু যেন একই। ওই বান্ধবী ভয় দূর করতে, মনে সাহস আনতে ও বিভিন্ন গল্প বলতো ভীতুরামকে। সামনে শিক্ষক দিবস, ক্লাসে ১৭০ জনের মধ্যে নির্বাচিত হয়েছে দুইজন, ক্লাসে মেয়েদের মধ্যে স্মার্ট ও সাহসী ফাস্ট গার্ল রাজলক্ষ্মী আর ছেলেদের মধ্যে আমাদের ভীতুরাম। আটর্সের মেয়ে রাজলক্ষ্মী ইংরেজি পড়াবে আর বায়ো-সায়েন্সের ভীতুরাম পড়াবে বাংলা, এই দুই কমন বিষয় পড়ানো হবে ঠিক হল। এলো শিক্ষক দিবস প্রথমে রাজলক্ষ্মী ইংরেজি পড়ালো খুব সাহসের সঙ্গে। তারপর এল বাংলা পড়ানোর পালা, ভীতুমহাশয় বাংলার শিক্ষক সমীর বাবুকে ডেকে এসে, একা ক্লাসে প্রবেশ করা মাত্রই সবাই দাঁড়িয়ে যেই বলে ‘গুড মর্নিং স্যার’, ভীতুমহাশয়ের বুকটা ধড়াশ করে ওঠে ও হৃদয়ের গতি সীমাহীন! তখন সবাইকে সে বসতে বলার জন্য যখন সামনে তাকিয়ে দেখে ক্লাসরুম যেন কানায় কানায় টইটম্বুর। ভয়ে কণ্ঠ শুকিয়ে হাহাকার! বন্ধু ফিরোজের কাছে এগিয়ে যেই বলে, ‘জলটা একটু দায় তো’ তেমনি সবাই হেসে উঠলো। পেছনের বেঞ্চে সমীর বাবু বসে আছেন চুপ করে। ফিরোজের কাছে জল পান করে বাংলা বইটি নিয়ে, ‘কর্তার ভূত’ পড়ালো ও বোঝালো প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে। প্রশ্নের উত্তরও বেশ দিল। প্রায় ভীতুরামের ভয়টা অনেক কেটে গেছে। স্কুল থেকে ফিরে বিকেলে হলে দূর থেকে সুনন্দিতাকে দেখা ও আনন্দ পাওয়া এটাতো চলতো তার। 

                এই ভাবে আনন্দে দ্বাদশ শ্রেণি অতিবাহিত হল উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে। পরীক্ষার ফল বেশ ভালো হয়েছে। ভীতুরাম স্টার পেয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে কৃতী ছাত্রের সম্মানও পায়। একদিন গ্রামের পাশে এক ক্লাবে কৃতী ছাত্র-ছাত্রী সম্মানের জন্য ভীতুরামকেও ডাকা হয় এবং সেখানে সম্মান সরূপ স্মারকলিপি ও বক্তব্য সে দেয়। পরের দিন রাস্তায় ভীতুরামের বাল্য প্রেমিকা সুনন্দিতা তার মায়ের সঙ্গে দেখা। আর তার মায়ের মুখে শোনে যে ভীতুরামের বক্তৃতার কণ্ঠা শুনে সুনন্দিতা তার মাকে ডেকে জানাচ্ছে। এই শুনে ভীতুরাম অন্তরে আনন্দে আত্মহারা। তারপর তার মা চলে যায়। আনন্দে পাগল ভীতুরাম দূর থেকে মেয়েটির বাড়ির দিকে তাকায় এক পলকে দেখার জন্য এবং তাকে দেখতেও পায়। ভীতুরাম বাড়িতে গিয়ে বসে বসে এটাই ভাবে ‘এটা মোহ না প্রেম’। কারণ মেয়েটির মধ্যে ভীতুরামের মতো কোন প্রেমের উপসর্গ ভীতুরাম হয়তো লক্ষ্য করতে পারছিল না। 
             ভীতুরাম কলেজে ভর্তি হয়। তার প্রিয় দুই বান্ধবী ও একজন বন্ধু বিধানের বিয়ে হয়ে যায়। এবং ভীতুরামের প্রিয় ঠাকুমার মৃত্যুও হয়। ভীতুরাম তার ঠাকুমার জন্য খুবই কেঁদে ছিল।এই ভাবে আরও এক বছর কেটে গেল। ভীতুরাম না কোনদিন মেয়েটির সাথে কথা বলেছে না এখনো ভালোবাসা কথা প্রকাশ করেছে। করণ সে ভাবতো সুনন্দিতার পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে আর তার বেকারত্ব ও বাবার বন্ধুত্ব ছিল। সে শেষে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে মেয়েটি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলেই ভালোবাসার কথা জানাবে। ভীতুরাম চাইতো যে, সুনন্দিতা নিজে থেকে যেন তাকে বুঝতে পারে ও তার ভালোবাসা অনুভব করতে পারে। ভীতুরাম সদাই সুনন্দিতার হৃদয়ের বিরল ভাব ও চরিত্রকে ভালো বেসেছে। ভীতুরাম ছিল এমনই। 

              সেই ভীতুরামের ছোট্ট সুনন্দিতা এখন কিশোরী। তবুও মেয়েটির অন্তরের সেই বিরল ভাব ও চরিত্র যা ভীতুরামকে লোভায় এখনও ঠিক একই রকম- তার ছোট্ট বোনের সাথে সুমধুর অনন্য এক মমতার সাথে খেলা করা, ছোট্ট গোবৎসের সাথে অপরূপ উল্লাসে প্রেম ভরপুর বাধাহীন কোমলতায় আদর করা, মনোহর মৃদু হাসিতে অপ্রতিম এক ভ্রুকুটিতে ভীতুরামের দিকে তাকানো, বিকেলে একা কিছু ভাবতে ভাবতে পায়চারি করার মধ্যে তার অজান্তেই কিছু কিছু সুক্ষ আচরণগুলি যা শুধুই ভীতুরামের নজরে পড়তো, আরো অনেক সুক্ষ আচরণ। আজব দৃষ্টিকোন ভীতুরামের। মেয়েটি পড়াশোনায় খুবই ভালো। ক্লাসে তার স্থান এক নং। বর্তমানে মেয়েটির পিতা পঞ্চায়েত প্রধান। দোতালা পাকা বাড়ি। তাই ভীতুরাম বসে চিন্তা করতো, ‘এমন পরীর মতো মেয়ের জন্য হয়তো তারা আরো ভালো কোন ছেলে চায়’! আবার এ বলে নিজে শান্তনা পেত ‘সুনন্দিতা কি চায়? তার কথাই শেষ কথা’। ভীতুরাম শুধুই মনের কথা একবার বলতে চায় মেয়েটিকে। সেই বিকেল হলে সব কাজ ফেলে বন্ধু কাকুকে বা প্রিয় বন্ধু ফিরোজকে নিয়ে রাস্তায় পাদচারণ করে শুধু একটু তাকে দেখার জন্য। শুধুই ফিরোজ ব্যাপারটা  জানতো। মেয়েটিকে নিয়ে ভীতুরাম কবিতা ও গল্প বেশ লিখেছে। যেমন- ‘সুনন্দিতা’, ‘শারদে সুনন্দিতা’, ‘বিকলে তুমি’, ‘তোমার স্বপ্ন’, ‘একা লাগেনা ভালো’, ‘প্রকাশ হোক প্রেম’, ‘ভয় নয় প্রিয়ে’ আরো অনেক কবিতা ও গল্প রয়েছে। এই ভাবে তার ভালোবাসার মোট নয়টা বছর কেটে গেছে। মেয়েটি এবার উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে ফেলেছে। পরীক্ষায়  ফল দারুণ। এবার আমাদের ভীতুরামের সাহস দেখানোর পালা। সে বুঝে উঠতে পারছেন না কি ভাবে তাকে তার মনের কথা বলবে! আরো একটা ভয় তার মনে ‘যদি স্কুলে কাউকে পছন্দ করে থাকে, না-না-না’। যাইহোক ভীতুরাম দৃঢ় প্রতিজ্ঞা বদ্ধ যেমন হোক জানাবে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার নয় বছরের প্রেম, তার লেখনীর মাধ্যমে বইতে প্রকাশ করে সুনন্দিতাকে পড়ার জন্য উপহার দেবে। এই ভেবে আমাদের ভীতুরাম লিখতে শুরু করল ‘অসমাপ্ত প্রেম’। 

Comments

Popular posts from this blog

মাগো - সুবোধ কুমার শীট

সুনন্দিতা - সুবোধ কুমার শীট

বিকেলে তুমি - সুবোধ কুমার শীট